আজ বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) শুরু হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। রাজধানীসহ দেশের সব কলেজে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির দীর্ঘ পথচলার সমাপ্তি ঘটল আজকের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। পরীক্ষার্থীরা জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে পা রাখছে, হাতে কলম, চোখে স্বপ্ন। তবে এই নতুন শুরুতে কিছু চেয়ার রয়ে গেছে শূন্য, কিছু নাম ডাকা হয়নি উপস্থিতির খাতায়।
সেই চেয়ারে বসার কথা ছিল ছয় তরুণের—আবদুল্লাহ বিন জাহিদ, মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (ফারহান ফাইয়াজ), শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ, আফিকুল ইসলাম সাদ, মারুফ হোসেন ও মো. আব্দুল আহাদ সৈকত। আজকের পরীক্ষায় তাদেরও অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা কেউ নেই।
গত বছর জুলাই ও আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল এই তরুণরা। পুলিশের গুলিতে নিহত হন তারা। কেউ শহীদ হয়েছেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি, কেউবা আগস্টের শুরুতে। অনেকে মৃত্যুর আগমুহূর্তেও ফেসবুকে লিখে গেছেন বিদায় বার্তা, কিছু স্বপ্ন, কিছু আশা। আর আজ তাদের সহপাঠীরা পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকার সময় চোখের কোণ মুছে নিয়েছে। বন্ধুরা নেই, আছে শুধু তাদের গল্প, কিছু না-পাওয়া, আর গভীর শোক।
আবদুল্লাহ বিন জাহিদ, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাতে উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। মৃত্যুর তিন মাস পর ছিল তার ১৭তম জন্মদিন। তার মা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, “ওর বন্ধুদের মুখে যেন আমার ছেলেকে খুঁজে পাই।” তিনি এখনো সন্তানহারা শোকে কাতর। তার ছোট ছেলের ক্যানসার ও স্বামীর মৃত্যুও তাকে করেছে একা।
ফারহান ফাইয়াজ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৮ জুলাই আন্দোলনের সময় বুকের বাম পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। গবেষক হবার স্বপ্ন ছিল তার। বাবা শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া জানালেন, “ও বিদেশে পড়তে চেয়েছিল, দেশে ফিরে গবেষণায় কাজ করতে চেয়েছিল।”
আহনাফ, বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। গানপ্রিয়, স্কাউট সদস্য, বন্ধুদের ভরসাস্থল। ৪ আগস্ট মিরপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। মঙ্গলবার তার মাকে গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার হাতে নিয়েই তিনি ছেলের প্রতিকৃতিতে চোখ রেখে কেঁদে ফেলেন, বললেন, “আজ ও বেঁচে থাকলে পরীক্ষায় যেত।”
মারুফ হোসেন, ১৯ বছর বয়সী তরুণ, ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই নজরদারির মধ্যে ছিলেন। ১৯ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হন। তিন দিন পর তার মরদেহ পাওয়া যায় অর্ধগলিত অবস্থায়। বাবা জানান, “কবরস্থান থেকে বলা হয়েছে ১০ লাখ টাকা না দিলে কবর রাখবে না।”
সৈকত, ঢাকা কমার্স কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ৫ আগস্ট বাবার সঙ্গে বিজয় মিছিলে অংশ নেন। সন্ধ্যায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। বাবা বলেন, “আমি পাশে ছিলাম, কিছু করতে পারিনি।”
সাদ, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র। ফ্রিল্যান্সার ও ডিজাইনার হিসেবে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাইতেন। ৪ আগস্ট রাতে ফেসবুকে শেষ পোস্টে লিখেছিলেন, “যে দেশের ইতিহাস রক্ত দিয়ে শুরু হয়েছে, ওই ইতিহাস আবার লিখতে রক্তই লাগবে।” ৮ আগস্ট মারা যান ধামরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে।
আজকের দিনটা কাউকে এনে দিয়েছে নতুন পথচলার সুযোগ, কাউকে দাঁড় করিয়েছে অসীম শূন্যতায়। কেউ কলম হাতে পরীক্ষা দিয়েছে, কেউ দাঁড়িয়ে থেকেছে সন্তানহারা কবরের পাশে। কেউ পরীক্ষার পর ফিরে পেয়েছে মায়ের কোলে সান্ত্বনা, কেউ ফিরেছে কেবল একটা ছবির দিকে তাকিয়ে।
তারা আজ নেই, কিন্তু তাদের গল্প আছে—ভরা আছে অশ্রুতে, সাহসে, আর রক্ত দিয়ে লেখা ইতিহাসে।
তাদের চেয়ার শূন্য, কিন্তু স্মৃতিতে পূর্ণ।