নাজমুস সাকিব
কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদী শুধু একটি নদী নয়। এটি এ জনপদের প্রাণ, ইতিহাস, জীবিকা ও সংস্কৃতির ধারক। সেই নদীর বুকেই তৈরি হয়েছে একটি জাতীয় সম্পদ – ইলিশের অভয়াশ্রম। সরকারের কাগজে-কলমে এটি নিরাপদ। বাস্তবে? প্রশ্নবিদ্ধ।
আন্ধারমানিক নদীকে ‘ইলিশের নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ ঘোষণা করা হলেও, নদীর বুকে এখন শান্তির চেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তা। নিয়ম বহির্ভূত ট্রলার চলে রাতে, নিষেধাজ্ঞার সময়েও চলে জাটকা নিধনের উৎসব। নদীর বুক চিরে অপরিকল্পিত ড্রেজিং, পিলার বসিয়ে সেতু নির্মাণ, বালু ফেলে নদীর গতিপথ রুদ্ধ- সব মিলিয়ে অভয়াশ্রম যেন পরিণত হয়েছে ‘আতঙ্কাশ্রমে’।
একটি নদীতে তিনটি সেতু—এই উন্নয়নের অর্থ কী? আন্ধারমানিক নদীতে জেলা পরিষদের পুরনো সেতুর পাশে এলজিইডির নতুন ব্রিজ। আবার তার সামনেই পায়রা বন্দরের সংযোগ সেতু। নদীটি যেন এখন বালু, পিলার আর কংক্রিটের বোঝা বইতে বইতে হাঁপিয়ে উঠেছে। এ স্রোতহীন নদীতে ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মা ইলিশ আর ডিম ছাড়তে সাহস পায় না, কারণ নদী এখন আর আগের মতো শান্ত ও প্রবাহমান নেই। নদীর তলদেশে জমে থাকা পলি ও দূষণ আরও ভয়াবহ।
তবু, স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। দিনে নিষেধ, রাতে ছুটে চলে ট্রলার। যেন এক অদৃশ্য ছায়া সবকিছুকে আড়াল করে রাখে। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। নীতি আছে, কিন্তু নৈতিকতা কোথায় ?
ইলিশ বাংলাদেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও সংস্কৃতির প্রতীক। আর ইলিশের নিরাপদ আশ্রয় যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে ক্ষতি শুধু মৎস্য খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না- এর অভিঘাত পড়বে সমগ্র উপকূলীয় জীবনব্যবস্থায়। একটি নদীকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে এ ‘অভয়াশ্রম’ হবে শুধু একটি প্রতারণার নাম। নদী ও ইলিশ বাঁচাতে হলে দরকার বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা। জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিশ্চিতকরণ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখা-এ গুলো একসাথে না হলে, অভয়াশ্রম কেবলই হয়ে থাকবে নিঃসঙ্গ প্রতীক।
ঢাকা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাশরাফি কামাল শাফি বলেন, নদীকে ঘিরেই গড়ে ওঠে একটি অঞ্চলের সামাজিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আন্ধারমানিকের অব্যবস্থাপনা ও দূষণ শুধু ইলিশ নয়, পুরো উপকূলের জলবায়ু সহনশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। অভয়াশ্রমের নামে যদি শুধুই উন্নয়নের চাপ বাড়ে, তবে একদিন হয়তো আমাদের সন্তানরা শুধু বইয়ের পাতায় ইলিশকে চিনবে। এখনই সময় নদী ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের উপকূলীয় সমন্বয়ক মেজবাহ উদ্দিন মাননু বলেন, যে নদী জীবন দেয়, সেই নদীকে অবহেলায় মরতে দেওয়া মানে নিজেকেই ধ্বংস করা। আন্ধারমানিক কেবল একটি নদী নয়, এটি উপকূলের জলবায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষা মানে শুধু মাছ নয়, পুরো পরিবেশ ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। তাই অবিলম্বে নদীর স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জনগণকে একত্রে কাজ করতে হবে। সময় হাতে বেশি নেই।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক মুতাসিম বিল্লাহ বলেন,নদী একটি জীবন্ত সত্তা, এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে সামগ্রিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনের স্পন্দন। আন্ধারমানিকের মতো নদী যদি প্রাণ হারায়, তাহলে শুধু ইলিশ নয়—হারাবে একটি অঞ্চল তার অস্তিত্ব, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ। অভয়াশ্রম শুধুই ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকলে তা হবে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার নগ্ন স্বীকৃতি। এখনই সময়—প্রকৃতি ও পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়নের পথ খোঁজার।
https://shorturl.fm/m9QDB
aidl7o
https://shorturl.fm/CIQI0