নাজমুস সাকিব
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় স্থাপিত পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জ্বলে উঠছে দেশের আলো, কিন্তু সেই আলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্ধকার। কয়লা পোড়ানো থেকে শুরু করে নদী দূষণ, কৃষিজমি ধ্বংস থেকে শুরু করে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি-সব মিলিয়ে পায়রা এখন পরিবেশের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে।
পায়রায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। এর ফলে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড স্থানীয়ভাবে বায়ুদূষণ বাড়াচ্ছে, যার কারণে হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ।নদীপথে কয়লা পরিবহন ও ছাই ফেলার কারণে আন্ধারমানিক ও পায়রা নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে। মাছের প্রজনন কমে গেছে, জেলেরা কর্মহীন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে উর্বর তিন ফসলি জমি অধিগ্রহণ করায় কৃষকেরা হারিয়েছে জীবিকা, বাধ্য হয়ে কেউ শ্রমিক, কেউ দিনমজুরে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যখন নতুন করে পরিবেশের চাপ তৈরি করছে, তখন বিশ্বের উন্নত দেশগুলো একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে।যুক্তরাজ্য ১৪২ বছরের ইতিহাস শেষে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের শেষ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেছে। জার্মানি ২০৩৮ সালের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ পুরোপুরি বন্ধ করবে, তবে অনেকগুলো কেন্দ্র ২০৩০ সালের মধ্যেই বন্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতালি ২০২৫ সালের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।
ফ্রান্স ২০২৭ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে বেরিয়ে আসবে। কানাডা ২০৩০ সালের মধ্যে সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করবে।সুইডেন, বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়া ইতোমধ্যেই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেছে।
জাপান কিছু কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র বন্ধের পথে, যদিও সম্পূর্ণ সময়সীমা এখনও নির্ধারিত হয়নি।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, G7 দেশগুলো ঘোষণা দিয়েছে-২০৩৫ সালের মধ্যে তারা সব ধরনের unabated coal power plant বন্ধ করবে। অর্থাৎ যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি ব্যবহার নেই, সেগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।বাংলাদেশে উল্টো পথচলা যেখানে উন্নত বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় কয়লার পথ ছেড়ে দিচ্ছে, সেখানে উপকূলীয় ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে নতুন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই নয়। উপকূলের কৃষি, নদী, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের স্বাস্থ্য ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও তীব্র করে তুলছে এই কেন্দ্র।
বিদ্যুৎ আমাদের অপরিহার্য, কিন্তু তা যেন পরিবেশ বিনাশের বিনিময়ে নয়। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও জোয়ার-ভাটা শক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিই হতে পারে টেকসই ভবিষ্যতের সমাধান।পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে-আমরা কি বিশ্বের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবুজ জ্বালানির পথে হাঁটব, নাকি পরিবেশ ধ্বংস করে নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেব ?