নাজমুস সাকিব, কলাপাড়া
বাংলাদেশের নদী-খাল-বিল একসময় ছিল দেশীয় মাছের ভাণ্ডার। রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, শোল, বোয়াল, টেংরা, পাবদা থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রজাতির ছোট মাছ সাধারণ মানুষের পাতে নিয়মিত ওঠতো। কিন্তু বর্তমানে সেই মাছের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। এর প্রধান কারণগুলোর একটি হলো চায়না দুয়ার বুচনা জাল-যা এখন দেশের নদী ও জলাশয়ে নির্বিচারে ব্যবহার হচ্ছে।
চায়না দুয়ার বুচনা জাল হলো অতি সূক্ষ্ম ফাঁসের এক ধরনের জাল, যার ছিদ্র এতটাই ছোট যে, মাছের ডিম, রেণু এবং ছোট মাছ পর্যন্ত আটকা পড়ে যায়। এই জাল দিয়ে জেলেরা একসাথে বিপুল পরিমাণ ছোট মাছ ধরে ফেলতে পারে। এর ফলে মাছের প্রাকৃতিক বৃদ্ধি ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এখন অনেকগুলো প্রজাতি বিলুপ্তির পথে, আবার অনেক প্রজাতি ‘অতি বিপন্ন’ তালিকায় চলে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাছ ধরার মৌসুমে নির্বিচারে বুচনা জাল ব্যবহারের কারণে প্রজননকালীন সময়ে মাছ ডিম ছাড়তে পারছে না। মাছের বাচ্চা নদী-খালে বেড়ে ওঠার আগেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। দেশীয় মাছের পাশাপাশি ইলিশসহ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কলাপাড়া উপজেলার কৃষক সুলতান গাজী বলেন, আগে আমাদের খালের মাছেই সংসারের চাহিদা মিটতো। বাজার থেকে মাছ কিনতে হতো না। এখন আর খালে মাছ নাই, সব শেষ কইরা দিছে এই বুচনা জাল। ছোট মাছও ধরে ফেলে, ফলে বড় হবার সুযোগ পায় না। সরকার যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়, দেশীয় মাছ একেবারে হারায়ে যাবে। স্থানীয় জেলে হাসান বলেন, “আমরা বহুদিন ধরেই নদীতে মাছ ধরে জীবন চালাই। আগে জাল ফেললেই মাছ উঠতো, কিন্তু এখন নদীতে জাল ফেললেও কিছু পাওয়া যায় না। চায়না বুচনা জাল সব শেষ করে দিছে। ছোট-বড় সব মাছ ধরে ফেলে, তাই নদী এখন প্রায় খালি। আমাদের সংসার চালানোই কষ্ট হয়ে গেছে।
মৎস্য কর্মকর্তা অপু শাহা বলেন, আমরা দেখছি চায়না দুয়ার বুচনা জাল দেশের মাছের জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করছে। এটি শুধু দেশের প্রজাতিগত বৈচিত্র্য নষ্ট করছে না, বরং জেলেদের জীবনযাপনকেও প্রভাবিত করছে। মৎস্য বিভাগ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে, কিন্তু জালের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করতে জনগণের সচেতনতা এবং কঠোর আইন প্রয়োগ অপরিহার্য।
বাংলাদেশ মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, বুচনা জালসহ বিভিন্ন অবৈধ জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি এই আইন ভঙ্গ করলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধানও রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, বাস্তবে আইন প্রয়োগ খুবই দুর্বল। অনেক সময় প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ অভিযান চালালেও পরে আবারো একইভাবে জাল ব্যবহার করা হয়।
দেশীয় মাছ কমে যাওয়ায় পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। নদী-খালের পরিবেশ ও খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে। পাখি, কচ্ছপ, শাপলা-শালুকসহ জলজ উদ্ভিদও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ১. অবৈধ চায়না দুয়ার বুচনা জালের উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। ২. মৎস্য সংরক্ষণ আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ৩. বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টি করে জেলেদের সচেতন করতে হবে। ৪. প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরায় কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। ৫. পরিবেশবাদী সংগঠন, প্রশাসন ও সাধারণ মানুষকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।
চায়না দুয়ার বুচনা জাল শুধু মাছ নয়, বাংলাদেশের নদী ও জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য এক মহাবিপদ। আজ যদি এর ব্যবহার বন্ধ করা না যায়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশীয় মাছের স্বাদ ভুলে যাবে।