কলাপাড়াতে গত ১৭ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কিশোর-তরুণদের। মাদরাসা-স্কুল নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ মাদকে জড়িয়েছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাচ্চা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের কাছে মাদক ছিলো খুবই সহজলভ্য। এলাকাবাসীর নাকের ডগায় চলত মাদকের রমরমা ব্যবসা। এলাকার মুরুব্বিরা ভয়ে দেখেও না দেখার ভান করত। আমার নিজ এলাকা থেকে মাদক দূর করতে কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। একবার এমনও হয়েছিলো পুলিশ দিয়ে রেইড দিয়ে মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করিয়েছিলাম কিন্তু তৎকালীন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি লেখক ফোন করে সেই মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দিতে বলেন। স্থানীয় আওয়ামীলীগের কয়েকজন মাদক বন্ধে আমাকে সহযোগিতাও করেছিলেন কিন্তু তারা সফল হোননি। তখন থেকেই গোটা কলাপাড়া মাদকের বড় বাজার।
কলাপাড়া নিয়ে অনেকেই ইদানিং কাজ করছেন। নানা রকম পরামর্শ দিচ্ছেন। এটা আশার বাণী। হতাশার বাণী হলো এলাকায় এখনো মাদকের আখড়াকে পুরোপুরি নির্মুল করা যায়নি। মাদক ও মাদক বাহিনীকে নতুনরা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। শিক্ষার পরিবেশ এলাকা জুড়ে নাই। শিক্ষাঙ্গনে পড়ালেখার প্রতিযোগিতা নাই। চামচামি করার একটা পরিবেশ আছে। অথচ একজন সন্তানকে মানুষ করার জন্য শুধু পরিবার নয় বরং একটি সুস্থ ও নিরাপদ এলাকা দরকার। যে এলাকার মানুষের আত্ন-সম্মানবোধ থাকবে। তাঁর নিজস্ব ধর্মীয় ও আদর্শিক পছন্দ থাকবে কিন্তু সে ধর্মান্ধ ও দলান্ধ হবে না। চামচা হবে না।
ভৌগলিক কারণেই কলাপাড়া অনেকগুরুত্বপূর্ণ। এখানকার সন্তানরা অনেক মেধাবী। কিন্তু পরিবেশের কারণে তাঁরা অলস। চায়ের দোকানে দীর্ঘ সময়ে সময় নষ্ট করে মুরুব্বিরা। গিবত-পরনিন্দার আসর বসে। বেহুদা ও বাজে কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখে। জালিমদের সমীহ করে। উপর লেভেলের কাউকে দেখলে তেলের প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যত নিজেদের গড়তে হবে এমন ভাবনা শিক্ষিতদের মধ্যেই নাই। বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা, কর্মজীবন এগুলো নিয়ে কোনো আয়োজন নাই। এনজিও নির্ভর কিছু প্রোগ্রাম মাঝে মধ্যে দেখা যায়, যেখানে সচেতনতার চেয়ে কিছু ইনকাম ও ফুটেজে থাকার প্রবণতাই বেশি ফুটে ওঠে। শিক্ষকদের বড় একটা অংশ পড়াশোনার মধ্যে নাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ বছর পড়ালেখা করে ইংরেজি, বাংলা ও আরবি ভাষায় পারদর্শী হওয়া শিক্ষার্থী কম। কোচিং সেন্টার থাকলেও অধিকাংশে কোচিং সেন্টার এর মান নাই।
দলের ও ধর্মের পার্থক্য থাকলেও বেশকিছু বদঅভ্যাস এর মিল আছে সকলের মাঝে। সেটা হলো- দক্ষতা, যোগ্যতা বৃদ্ধির বদলে অলস জীবন যাপন করে কার দল সেরা এই বিতর্কে বেশি সময় নষ্ট করে রাজনৈতিক কর্মীরা। কোনো দলই পড়ালেখার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট নয়। বংশীয় গৌরব, দেমাগ, অহংকার দেখানোর ক্ষেত্রে সবাই একধাপ এগিয়ে। নিজ সন্তানকে সবাই ভালোবাসলেও প্রতিবেশির সন্তান ভালো করুক এটা অনেকেই চায় না। এলাকার নেতৃত্বে যারা থাকে এদের বড় একটা অংশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতির বদলে নিজ কর্তৃত্ব ও সিন্ডিকেট টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর। এ সকল সঙ্কট এর সমাধান আসতে হবে কলাপাড়ার সকল স্টেকহোল্ডার, সাংবাদিক, সুশীলসমাজ ঢাকায় অবস্থানরত কলাপাড়ার বিভিন্ন সমিতি, সংঘ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সদিচ্ছা ও বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে। রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও এর সমাধান থাকতে হবে।
মুতাসিম বিল্লাহ
সহকারী অধ্যাপক,
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি,
ফিচার রাইটিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।