যে শহরকে সবাই চা-বাগান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য চেনে, তার বুকের নিচে ঘুমিয়ে আছে শত বছরের ইতিহাস, যেটা হয়তো অনেকেই জানেন না।
শ্রীমঙ্গল — বাংলাদেশের ‘চা রাজধানী’ নামে পরিচিত একটি শহর। তবে শুধু চা নয়, ইতিহাস আর সংস্কৃতির দিক থেকেও এই জনপদের রয়েছে বিস্ময়কর কিছু অধ্যায়।
চলুন, আজ জানি সেই শ্রীমঙ্গলের কিছু অজানা ইতিহাস, যা হয়তো পাঠ্যবইয়ে নেই, কিন্তু সময়ের গর্ভে অমূল্য।
১. নামের উৎপত্তি নিয়ে কিংবদন্তি:
“শ্রীমঙ্গল” নামটি নিয়ে রয়েছে একাধিক মত। সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হলো — দুই ভাই “শ্রী” ও “মঙ্গল” এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। তাঁদের নামেই জায়গাটির নাম হয় “শ্রীমঙ্গল”।
আবার অনেকে বলেন, “শ্রী” মানে ‘সমৃদ্ধি’ আর “মঙ্গল” মানে ‘মঙ্গলজনক’। অর্থাৎ একটি সমৃদ্ধ ও কল্যাণময় জনপদ।
২. ব্রিটিশদের চা উপনিবেশের সূচনা:
১৮৫৪ সালে ব্রিটিশরা প্রথম শ্রীমঙ্গলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। শ্রীমঙ্গল ছিল ব্রিটিশ চা কোম্পানির অন্যতম কেন্দ্র।
এই অঞ্চলের বাগানগুলোর মালিকানা ছিল ইংরেজ সাহেবদের হাতে। তাঁরা এখানেই তৈরী করেন বাগান-বাড়ি, অফিস, লেবার লাইন এবং রেললাইন — যা এখনও অনেক জায়গায় বিদ্যমান।
৩. দেশের প্রথম চা-রপ্তানি কেন্দ্র:
১৯২০ সালে শ্রীমঙ্গল থেকে প্রথম চা রপ্তানি হয় ব্রিটেনে।
শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশন ছিল দেশের প্রথম চা রপ্তানিকেন্দ্র। এখান থেকেই ট্রেনযোগে চা পাঠানো হতো চট্টগ্রাম বন্দরে।
আজও রেলস্টেশনের পাশে পুরনো গুদামঘর সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
৪. শতাব্দী পুরোনো মন্দির ও ধর্মীয় সম্প্রীতি:
শ্রীমঙ্গলে রয়েছে প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো সাতচূড়া শিবমন্দির, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘সাত গম্বুজ মন্দির’ নামে।
এছাড়া রয়েছে বহু পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির ও গির্জা, যা ব্রিটিশ চা শ্রমিকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
৫. ভাষা আন্দোলনের গোপন কেন্দ্র:
অনেকেই জানেন না — ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় শ্রীমঙ্গলেও গোপনে মিটিং এবং লিফলেট বিতরণ করা হতো।
তৎকালীন তেলিয়াপাড়া চা বাগানের শিক্ষিত শ্রমিক ও শহরের তরুণেরা এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
তাঁদের অনেকের নাম ইতিহাসের পাতায় ওঠেনি, কিন্তু তাঁদের অবদান স্মরণীয়।
৬. ব্রিটিশ অফিসারদের বাগান বাড়ি ও গোপন টানেল:
বলা হয়ে থাকে, শ্রীমঙ্গলের কয়েকটি পুরনো চা বাগানে (যেমন: ভাড়াউড়া, মির্জাপুর) ব্রিটিশদের তৈরি গোপন টানেল ছিল — যাতে প্রয়োজনে পালাতে পারেন।
যদিও এখন অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবু স্থানীয় প্রবীণরা এসব গল্প এখনও বলেন।
৭. চা বাগান সংস্কৃতি ও নিজস্ব ভাষা:
চা-শ্রমিকদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, গান, নাচ ও পোশাক।
এদের অনেকেই ওড়িষ্যা, বিহার ও ছত্তিশগড় থেকে আনা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে।
তাঁদের গানে, গল্পে, উৎসবে ফুটে ওঠে এক অনন্য সংস্কৃতি — যা বাংলাদেশের আর কোনো জায়গায় দেখা যায় না।
আজকের আধুনিক শ্রীমঙ্গল হয়তো পর্যটনের জন্য পরিচিত, কিন্তু ইতিহাসের এই শহরে রয়েছে এমন সব অধ্যায় যা সংরক্ষণ ও চর্চা করার দাবি রাখে।
এই অজানা ইতিহাস জানলে চা পানের সময়ও হয়তো আমরা একটু বেশি শ্রদ্ধা দেখাবো সেই মানুষগুলোর প্রতি, যাঁরা এই চায়ের জন্ম দিয়েছেন — এবং সেই শহরের প্রতিও, যেটি এই ইতিহাস বহন করে চলেছে শত বছর ধরে।
লেখক: মো. আব্দুল্লাহ আল যোবায়ের
লেখক ও সমাজকর্মী
শিক্ষার্থী, শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ