কুরবানির মৌসুম সমাগত। এই সময় মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মৌসুম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, অনেকেই এই মহৎ ইবাদতে লিপ্ত হয়ে থাকেন কিন্তু তার মৌলিক আদব, শর্ত ও শরয়ি বিধান সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকায় নানা ভুল করে বসেন, যার ফলে ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য বিফল হয়।
এ প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গাফেলতির আলোচনা তুলে ধরছি, যেন আমরা সচেতন হই এবং কোরবানিকে বিশুদ্ধভাবে সম্পাদন করতে পারি…
১. ইখলাসহীন নিয়ত:
বর্তমানে কোরবানি অনেকের কাছে ইবাদতের চেয়ে সামাজিক প্রতিযোগিতা হয়ে উঠেছে। কে কত বড় গরু জবাই করল, কারটা কত দামী — এই চিন্তাই হয়ে দাঁড়ায় মুখ্য।
মূল নিয়তের জায়গা থেকে সরে গিয়ে চিন্তা হয়: “মানুষ কী বলবে?”
কোরবানি তখন আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং লোক দেখানো এক উৎসবে রূপ নেয়।
অথচ ইসলাম বলেছে, ইখলাস (আন্তরিকতা) ছাড়া কোনো ইবাদত কবুল হয় না।
📖 আল্লাহ তাআলা বলেন:
“বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।”
(সূরা আন’আম: ১৬২)
📖 রাসূল ﷺ বলেন:
“সমস্ত কাজই নিয়তের উপর নির্ভর করে।”
(সহীহ বুখারী: ১)
২. ভুল সময়ে কোরবানি:
অনেকে ঈদের নামাজের আগেই কোরবানি করে ফেলেন, যা সহীহ নয়। কোরবানির সময় শুরু হয় ঈদের নামাজের পর থেকে।
📖 হাদীস:
“যে ব্যক্তি নামাজের আগে কোরবানি করল, সে কেবল নিজের পরিবারের জন্য গোশত প্রস্তুত করল, তার কোরবানির কোনো অংশ নেই।”
(সহীহ বুখারী: ৯৮৪)
৩. শরয়ি মানদণ্ডহীন পশু কোরবানি:
অনেকে অযোগ্য পশু কোরবানি করেন, যেমন:
– দুই বছর পূর্ণ হয়নি,
– চোখে সমস্যা আছে,
– খোঁড়া বা দুর্বল।
📖 রাসূল ﷺ বলেন:
“চার প্রকার পশু কোরবানিতে চলবে না: স্পষ্ট অন্ধ, স্পষ্ট অসুস্থ, স্পষ্ট খোঁড়া, এমন দুর্বল যা অস্থি-মজ্জাও রাখে না।”
(আবু দাউদ: ২৮০২, সহীহ)
৪. জবাইয়ের সময় শরীয়তের নির্দেশনা লঙ্ঘন:
– “বিসমিল্লাহ” না বলা,
– কিবলামুখী না করা,
– ভোঁতা ছুরি ব্যবহার করা — এসব গুরুতর গাফেলতি।
এগুলি পশুর প্রতি অমানবিকতা তো বটেই, ইবাদতের আদব লঙ্ঘনের নামান্তর।
📖 আল্লাহ বলেন:
“যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি, তা খেয়ো না।”
(সূরা আন’আম: ১২১)
📖 রাসূল ﷺ বলেন:
“আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের ওপর ইহসান ফরজ করেছেন… ছুরি ধারালো করো এবং পশুকে কষ্ট দিও না।”
(সহীহ মুসলিম: ১৯৫৫)
৫. পশুর সঙ্গে নিষ্ঠুরতা:
– লাঠিপেটা করা,
– অন্য পশুর সামনে জবাই করা,
– জোর করে টানা-হেঁচড়া করা — এসব ইসলামে হারাম ও নিষিদ্ধ আচরণ।
📖 হাদীস:
“যে কোরবানির পশুর প্রতিও দয়া করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার ওপর দয়া করবেন।”
(মুসনাদ আহমাদ)
৬. গরিবদের হক আদায়ে গাফেল:
কোরবানির গোশতের তিন ভাগ:
– নিজে খাওয়া,
– আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া,
– গরিবদের দেওয়া।
অনেকে গরিবের হক আদায় না করে নিজেরাই রেখে দেয় সব।
📖 আল্লাহ বলেন:
“তোমরা তা থেকে খাও এবং অভাবী দরিদ্রকে খাওয়াও।”
(সূরা হজ্জ: ২৮)
৭. অপবিত্র অবস্থায় কোরবানি:
– অজু বা গোসল ছাড়া জবাই করা।
যদিও পবিত্রতা ফরজ নয়, তবে তা সুন্নাত ও ইবাদতের আদব।
📚 ইমাম নববী (রহ.) বলেন:
“যদি জবাইকারী নাপাক থাকে, তাহলে জবাই সহীহ হবে; কিন্তু তা মাকরুহ।”
(আল-মাজমু’)
কোরবানি কোনো উৎসব নয়, এটা তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ।
এটা শুধু পশু জবাই নয়, বরং আত্মার আত্মসমর্পণ।
📖 আল্লাহ বলেন:
“আল্লাহর কাছে পশুর গোশত বা রক্ত পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছায়।”
(সূরা হজ্জ: ৩৭)
আসুন, এই কোরবানির মৌসুমে আমাদের নিয়ত, আমল, আচরণ ও শরীয়তের বিধানগুলো সঠিকভাবে মেনে চলি। যেন কোরবানি শুধু আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে, বরং ঈমান ও তাকওয়ার জীবন্ত নিদর্শন হয়ে ওঠে।
📿 আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুলযোগ্য কোরবানির তাওফিক দিন। আমীন।